তিন বাবার গল্প

এক.

মিঃ ‘জ’ তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সব আবদারই রাখতে সাধ্যমত পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। ঢাকায় এসেছিলেন স্বাধীনতার পর পর। যে এলাকায় স্ত্রী নিয়ে বসবাস শুরু করেন সেটা ছিল আস্ত গ্রাম। ধান চাষ হতো। ক্যানেলের মাধ্যমে সুইচ গেটের মাধ্যমে ডিএনডি বাধের পানি এলাকার কৃষির উন্নতি করতো।

আশির দশক থেকে খুব দ্রুত এলাকার মানুষ বাড়তে থাকলো। মতিঝিলের খুব কাছে হওয়ায় মানুষ এখানে জমি কিনে বাসা বানাতে লাগলো। মিঃ জ এবং তার স্ত্রীকে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয় নাই। বিভিন্ন বাড়িওয়ালারা তাদের বাড়িটিতে ফ্রিতে থাকার অফার করে। একে একে তাদের পাঁচটি সন্তান হয়। চাকরীর টাকা থেকে কোন সঞ্চয় না করে সন্তানদের লেখাপড়া ও ভাল ভাল খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করে যায়।

এক সময় একটা বেসরকারী চাকরী ছেড়ে দেওয়ায় সেখান থেকে ভাল একটা টাকা এককালীনও পায়, যা দিয়ে ঢাকার সেই এলাকাটায় একশ কাঠা জায়গাও কেনা যেতো, কিন্তু সেই চিন্তা তার মাথায় আসে নাই। ব্যবসা করার চেষ্টা করে এবং একসময় সেই টাকাও সংসারে খরচ হয়ে যায়।

সন্তানরা বড় স্কুল পাস করে কলেজে যাওয়ার সময় সেই এলাকায় ভাড়া থাকার মতো অবস্থাও থাকলো না, ভাড়া অনেক বেশি -আরেকটু ভিতরে কোথাও ভাড়া থাকতে হবে। এলাকার পুরানো বাড়িওয়ালার অনেকে তাদের চিনে। তবে সমাজ কমিটি বলেন, মসজিদ কমিটি বলেন কোন কিছুতেই মিঃ ‘জ’ এর মূল্য নাই।

বাস্তবতা হলো ১৯৭৬ সালে কয়েক হাজার টাকা কাঠা জমির দাম ২০০০ সালে বিশ লাখ টাকা কাঠা দাম হয়। ২০২০ সালে সেখানে কোন জমি বেচা কেনা হয় না, শুধু ফ্লাট বিক্রি হয়।

তখন সন্তানরা তাদের বাবা ও মায়ের দোষ দিতে থাকলো। আমাদের এত খাওয়ানোর বা ভাল রাখার কোন দরকার ছিল না। আপনারা ভুল করেছেন। এখন আমাদের ভবিষ্যত কি? এই এলাকায় জন্মেও আমরা এই এলাকার কেউ না! বাবা মায়ের এই ভুলের কথা সন্তানরা সব সময়ই সুযোগ হলেই বলে ফেলে।

বাবা মায়ের ইকনমিক্যাল জ্ঞানের অভাবের দোষ কি সন্তানের দেওয়ার অধিকার আছে? তারা তো সন্তানদের ভাল খাওয়া পড়ার জন্যই চাপ নিয়ে জমি কিনে নাই।

Photo by Josh Willink from Pexels

দুই.

এক বাবার গল্প জানি যিনি একটা সময় দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং প্রথম স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে আলাদা হয়ে বসবাস শুরু করে। আগের তিন সন্তানরা বড় হয়, বাবার সাথে খুব একটা সম্পর্ক রাখে না।

এক সময় বাবা তাদের আগের সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে যেতে বললো। বাবা চাইলো তার আগে সন্তানদের কিছু জমি ও সম্পদ ভাগ করে দিতে। যেহেতু নতুন পরিবারের স্ত্রী সন্তানদের দখলে থাকার কারনে সে মারা গেলে সম্পদ ঠিক মতো নাও পেতে পারে।

সন্তানরা রাগ করে বলে যে বাবার কোন জমির দরকার নাই।

এই সন্তানদের মধ্যে একজনের আমার পরিচয় হলো এবং আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, জমি নিয়ে নিতে। আমি তাকে বললাম, তুমি তোমার স্ত্রীকে নিয়ে গিয়ে তার সাথে ভাল ব্যবহার করতে থাক। কথা মতো সে তাই করলো। বাবা যে জমিগুলো তিন ভাইবোনকে দিতো তার সবই তাকে লিখে দিলো।

আরো জমি লিখে দিতে পারে।

আমি এবার পরামর্শ দিলাম, প্রতিমাসে বাবাকে অল্প কিছু হলেও হাত খরচের জন্য দিবে। তোমার মায়ের সাথে যা হয়েছে তা তুমি আসলে সত্যিটা জানো না। নিজেকে বঞ্চিত করে কি লাভ?

Photo by nappy from Pexels

তিন.

তিনি আরেকজন হতভাগা বাবা। তিনি তার যৌবনে বিদেশে গিয়ে অনেক টাকাই আয় করেন। সামান্য খরচের টাকা স্ত্রীকে দিয়ে সব টাকাই তার এক খালাতো ভাইয়ের কাছে পাঠাতো। খালাতো ভাই বলল, কিছু জমি দেখছি, তোমার জন্য কিনবো, ভবিষ্যতে লাভ হবে।

টাকা পাঠালো এবং খালাতো ভাই নিজের নামে জমি কিনলো। বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর জমি ও টাকা কিছুই পেল না। এর পর বেশি দিন আয় করতে পারে নাই, সামান্য কিছু আয় করে অল্প কিছু জমি কিনতে পেরেছে।

সন্তানরা স্কুল শেষ করে কলেজে পড়ে। বাবা অনেকটা অসুস্থ্যের মতো হয়ে যায়। মা পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বাবার সাথে স্ত্রী ও সন্তানরা দুঃব্যবহার করতে থাকে। কখনো বা বাবাকে তুই করে বলে, গালী দেয়, খাবার খেতে কখনো ডাকে না। তাকে ধরে মারে কিনা জানি না। পরিবারের কোন অনুষ্ঠানেও তাকে গুরুত্ব দেয় না। মা-ই সব।

Thambnail Photo by Josh Willink from Pexels